বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ অপরাহ্ন
অতিমাত্রার ঢিলেঢালায় দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেন মুখ থুবড়েই পড়ে থাকলো। এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেল অথচ পুলিশ কোমড় তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। দাঁড়ানোর সুযোগ দেখাও যাচ্ছে না।সকল পর্যায়ে রদবদলের অস্থিরতা, বাধ্যতামূলক অবসর, আন্দোলনে হত্যার অভিযোগে মামলা, গ্রেফতার মিলিয়ে পুলিশ বেহাল অবস্থায় আছে। এখনও থানার বাইরে সক্রিয় কোনো কর্মতৎপরতা নেই। থানায় গিয়ে কেউ জিডি, মামলা দিলে রেকর্ড হয়, তবে সেসবের ভিত্তিতে করণীয় কিছু হয় না। জড়ো পদার্থের মতো নির্জীব হয়ে থাকা পুলিশ নিজেরাই তটস্থ। চাকরি ক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, পদে পদে অমর্যাদা। এখন ছিঁচকে অপরাধীদের দ্বারাও ধমক খাওয়া এ পুলিশ দিয়ে আর যাই হোক আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না, হবেও না। পুলিশ সংস্কারের অজুহাতে সবকিছু যেমন আছে তেমন ফেলে রাখার মাধ্যমে গোটা দেশকেই সীমাহীন অরাজকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
কোথাও দুষ্টের দমন নেই, সাহায্য চেয়েও আইন শৃংখলা বাহিনীর কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। আত্মরক্ষার জন্য থানায় জিডি করেই হামলা, মারধরের শিকার হচ্ছেন। চাঁপাই নবাবগঞ্জের সাংবাদিক আলমগীর থানায় জিডি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আসামিদের দ্বারা হামলার শিকার হন। পুলিশ সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে আসামিদের দ্বারা পাল্টা মামলা রুজুর পুরোনো খেলায় মেতে উঠেছে। চট্টগ্রামে সাংবাদিক নাসিরের উপরও নির্মম হামলা চালিয়েছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে কিশোর গ্যাং চক্র ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিক সম্পাদক খায়রুল আলম রফিকের বাড়ি ভাংচুর করেছে, হামলা চালিয়ে তার অন্তঃসত্ত্বা বোনসহ কয়েকজনকে আহত বানিয়েছে। ঘণ্টাব্যাপী এ হামলাকালে থানার ওসি, জেলার এসপি এমনকি ডিআইজিকে জানানো সত্ত্বেও পুলিশ সেখানে যাওয়ার মতো সাহস দেখাতে পারেনি। কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে যদি থানা পুলিশ, জেলার এসপি চুপসে থাকে তাহলে অসহায় মানুষ কার কাছে যাবে? কার সাহায্য চাইবে?
এরমধ্যেই ঢাকার একটি থানার ভিতরে কয়েক তরুণকে রীতিমত চেয়ার টেবিল ব্যবহার করে আড্ডাবাজিতে ব্যস্ত দেখা হলো। তারা ফেসবুকেই ঘোষণা দিলো যে কোনো অপরাধের ব্যাপারে থানায় আসুন অথবা তাদের দেওয়া মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করুন। এসবের মানে কি? নিজেদের ছাত্র দাবিদাররা থানার কার্যক্রম পরিচালনায় যুক্ত হলে অবস্থা কি দাঁড়ায়? তাহলে সব পুলিশ হটিয়ে ছাত্রদেরকে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে থানা পরিচালনার দায়িত্ব দিন। বেতন ভাতা দেওয়ারও ব্যবস্থা করুন। ভাবটা এমন যেন, কয়েক লাখ ছাত্রের পড়াশুনা গোল্লায় গেলে কি এমন ক্ষতি হবে!! বলা হয়েছিল পুলিশ যদি মেরুদন্ড সোজা করে কাজ নাই -ই করতে পারে তাহলে প্রতি থানায় ত্রিশ জনের একটি করে সেনা টিম দেওয়া হোক। তারাই থাকুক অভিযানিক কর্মকাণ্ডে। তবু ভঙ্গুর পুলিশি কার্যক্রম সচল থাকুক।
আয়না ঘর আর র্যাব বিলুপ্তি কবে?
——-
ভিন্নমতাবলম্বী কাউকে শায়েস্তা করতে অন্তর্বর্তী সরকারেরও সম্ভবত আয়না ঘর দরকার আছে। র্যাবের ব্যাটালিয়নে ব্যাটালিয়নে গড়ে তোলা অন্ধ কূপও লাগবে হয়তো! তা না হলে নাগরিকদের নির্মম নির্যাতনের, নিষ্ঠুর অত্যাচারের এসব বন্দীশালা এখনও দেশে বহাল আছে কিভাবে? র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে একটা করে অন্ধকূপের (আয়না ঘর) অবস্থান রয়েছে। একেকটি বিল্ডিং আছে যেটাকে আয়না ঘরে পরিণত করে রাখা আছে। সেখানে আয়না ঘরের ভয়াবহতা আরো নির্মম, আরো জঘন্য। ফ্লোর কেটে মানুষের গলা পরিমাণ গভীর করা আছে। হাতে পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে সেখানে সরাসরি নামিয়ে দাড় করিয়ে রাখা হয় মাসের পর মাস।
র্যাব-১ কার্যালয়ে মানুষকে জুস বানিয়ে ফেলার মেশিনও রয়েছে। এখনও সে মেশিন সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা যায়নি। তবে র্যাব ১১ এর ব্যারাক ও অফিসের মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে তোলা ভবনের সকল গুমখানা ভেঙে ফেলার খবর পাওয়া গেছে। বাকি সব ব্যাটালিয়নে তা বহাল রয়েছে। এসব গুমখানায় চার ফুট বাই আট ফুট আয়তনের একেকটি গুম ঘর, এরমধ্যেই বাথরুম- ভাবা যায় ব্যাপারটি! আয়না ঘর থাকার কথা শোনা গেছে পাঁচ তারকা হোটেল রূপসী বাংলার ১১ তলাতেও। র্যাব মূলত অত্যাচারী সরকারের বিশ্বস্ত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি ঠিকাদারির ভিত্তিতে জায়গা জমি দখল, ব্যবসা বাণিজ্য হাতিয়ে নেওয়া, কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার এন্তার তথ্য রয়েছে।
তাদের দ্বারা আইন শৃংখলা রক্ষায় আদৌ কোনো কাজ হয় না বরং পুলিশের মধ্যে বড় রকম বৈষম্য আর অসন্তোষ সৃষ্টির নিয়ামক হয়ে আছে। পুলিশ এক অভিযানে ৫০০/ ১০০০ টাকা পায় না, সেখানে র্যাব কোনো আসামি গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ৫০/৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত পুরস্কার পায়। এক গ্রেফতারকে এক পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়। একেক অভিযানিক দল প্রতি মাসে ৭/৮ টা পর্যন্ত পয়েন্ট জোগাড়ে মরিয়া থাকে। এই পুরস্কারের লোভেই একের পর এক ফিটিং অভিযান চলে, গ্রেফতার হয় নিরপরাধ মানুষ। এসব অভিযোগ মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে।
আগে ধারণা করা হতো জঙ্গী দমনে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে র্যাব। যখন জানা গেলো এ সবই ছিল সাবেক সরকারের জুলুমবাজী, ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিঃশেষ করার অপকৌশল- এর বাইরে র্যাবের কি আদৌ কোনো অর্জন আছে?দেশে এতো এতো সংস্থা থাকতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেনো র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল এখন তা বুঝতে আর কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ছাত্র জনতার আন্দোলনে হেলিকপ্টার থেকে বেশুমার গুলিবর্ষণসহ বড় বড় অপকর্ম চালিয়েও র্যাব কিন্তু যথেষ্ট আয়েশে রয়েছে। তাদের দপ্তরগুলো যদি থানা ফাঁড়ির মতো হামলার মুখে পড়তো তাহলে আয়না ঘরসহ ভয়ানক সব কাহিনী বেরিয়ে আসতো।
যা ছিল সবচেয়ে জরুরি
দেশের সকল অরাজকতা, জুলুমবাজি, দখল বেদখল, চাঁদাবাজি নিশ্চিহ্ন করে সর্বাগ্রে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনাটাই প্রধান কাজ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের। নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে সব ধরনের আতঙ্ক থেকে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া দরকার ছিল। জরুরি প্রয়োজন ছিল সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে বাজারদর নাগালের মধ্যে আনা। কিন্তু সেসব ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ধীরে চলা নীতি মানুষকে মোটেও স্বস্তি দিতে পারছে না। পাল্টা দখল আর অরাজকতা ছাড়া সরকার পরিবর্তনের কোনো সুফল এখনও দেখতে পাচ্ছে না জনগণ। এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমূলক (দৃষ্টান্ত অনেক পরের কথা) কিছুই করা যায়নি দেড় মাসেও।
তবে চলমান সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ হটিয়ে বিপরীত দলের লোকজনকে দায়িত্বে বসানোর ক্ষেত্রে খুব দ্রুত কাজে সক্ষমতা দেখাচ্ছে। সর্বশেষ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টেও দলীয় সাংবাদিককে দায়িত্ব দেওয়া হলো। এসব ব্যাপারে কোনো সময়ক্ষেপণ হচ্ছে না। তবে সাংবাদিকদের সুরক্ষায়, কালো আইন থেকে রেহাই দেয়া আর জনগণ উপকৃত হয় সেসব কর্মকাণ্ডে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। আশা ম্লান হতে শুরু হয়েছে তবু তা যাতে হতাশায় পরিণত না হয় সে কামনায় করছি।
সাঈদুর রহমান রিমন (লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক)